মণীষার মাধ্যাকর্ষণ : মুখোমুখি সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়
শব্দ প্রকাশ করে মনের ভাব ভাষা । আর শব্দ সুসজ্জিত হলে সরাসরি স্পর্শ করে হৃদয় । হৃদমাঝারে অন্তস্থ শব্দ জীবনের কথা বলে । কথা বলে ঠিক যতটা বলার প্রয়োজন ততটাই । প্রসাধন অতিরিক্ত হলে নারী নামক নারী যেমন ম্যানিকুইন হয়েওঠে ঠিক তেমনই অতি শব্দে গাজন নষ্ট হয় । একদা ধৃতরাষ্ট্রের উপদেশক ও সারথী ছিলেন সঞ্জয় ।আর আমাদের প্রজন্মে শব্দের সারথী অন্য সঞ্জয় ।সঞ্জয়
মুখোপাধ্যায়। তার স্মৃতির অতীতে অনেক ব্যক্তিত্বের জ্ঞানতত্ত্ব। তবে যে নামটি তার রক্ত বীজ-এ জ্বলন্ত। দিবারাত্রি। তিনি ঋত্বিক কুমার ঘটক । আধুনিক প্রজন্মকে সেই সব মণীষার দোরগোড়ায় পৌছে দেন তিনি । কি আশ্চর্য সেতুবন্ধন ! এটা তার দৈনন্দিন দিনলিপির একাংশ । যারা এই অতীব মূল্যবান মেধাদৃপ্ত মনোজ্ঞ সময়ের সাক্ষী ছিলেন না তাদের জন্য শুধু তাদের জন্য হাজির করলাম মণীষার মাধ্যাকর্ষণ ।
সব কিছু পুড়ে যায় থেকে যায় শুধু স্মৃতি ।আপনার স্মৃতির শরীরে বহু অভিজ্ঞতা । বহু জীবন । সেই জীবনের মানুষ আজও কি আপনার বর্তমান জীবনে প্রভাব ফেলে ?
সব কিছু পুড়ে যায় থেকে যায় শুধু স্মৃতি ---একথা ঠিক ।তবে আমি খুব স্মৃতি চারণ করার মানুষ নই । আমার বাড়ির সমস্ত ভাই-বোনদের মধ্যে আমি ছিলাম সব চেয়ে ছোট। শৈশবে প্রায় সময়-ই আমি পেটের অসুখে ভুগতাম । দুর্ঘটনা থেকে বহুবার ফিরে এসেছি । স্কুল-এ পাঁচিলের ধারে ঝুঁকে পড়ত কৃষ্ণচূড়া । সাহিত্যের প্রতি প্রীতি ছিল বরাবর-ই । বলা যেতে পারে কবিতার নারী দেখে বাস্তবের নারীর প্রতি আকর্ষণ অনুভব করা । কবিতার দুনিয়ায় পাতার রং খুব সবুজ ।বাস্তবের পাতা ততটা সবুজ নয়-ও ।শব্দ আমার পক্ষে চেনা বাস্তব ছিল । শব্দের তীরে নোঙ্গর ফেলেছিলাম আমি ।শব্দ দিয়ে খুঁজতে চাইতাম সমগ্র পৃথিবী । আমি যেটা খুঁজতে চাইছিলাম সেটা শুধু ফিলমের মধ্যে ছিল না । ছিল কবিতা ,গদ্য ,চিত্রকলার মধ্যেও । যেটা আমি উপলব্ধি করেছি সেটাকেই রূপান্তরিত করেছি শব্দেই । কতটা পেরেছি জানিনা । আমার বাড়ির খুব কাছেই ছিলেন কবি বিষ্ণু দে ।তার ভাড়া বাড়ির অদূরেই ছিল আমাদের বাড়ি।ওই মুসলমান কবরখানার কাছে উনি থাকতেন আর কালিঘাটের উল্টো দিকে থাকতাম আমরা ।ওনাকে নানরকম প্রশ্ন করতাম ।আর উনিও আমাকে প্রশ্রয় দিতেন ।এমনকি ওনার একটা বইয়ের রিভিউ করেছিলাম ।ওই রিভিউ ছাপা হয়েছিল ।আমি সেখানে বলেছিলাম ওনার কবিতাগুলো খুব সফল নয় ।সেটা দোষের নয় । তার তুলনায় অধিকতর অস্বস্তিকর, আমি লিখেছিলাম--- কেন উনি আটকে রইলেন নির্দিষ্ট গন্ডীর সীমানায়,আর কেন জীবনানন্দ অধিকতর সফল ।আজ ভাবলে লজ্জা করে ।এই লেখা নিয়ে কেউ বিষ্ণু দেকে পড়তে দিতে পারে সেই সময়ে সেটা ভাবনারও অতীত ছিল । আমি বিষ্ণুবাবুকে পড়তে দিয়েছিলাম । বিষ্ণুবাবু পড়েও ছিলেন কিন্তু খুব একটা আমার ওপর রুষ্ট হন নি । তারপরেও তিনি নানা কথা বলেছেন ।ওই লেখা নিয়ে আলোচনা করেন নি ।কিন্তু তার মধ্যে সস্নেহ প্রশ্রয় ছিল । বিষ্ণু দের মধ্যে দেখেছিলাম একধরণের সম্ভ্রম । যেটা আজকের কবিদের মধ্যে দেখা যায় না ।একটা সর্বব্যাপক চৈতন্য ,বিজ্ঞান ,দর্শন ,এবং কবিতার ।মনে আছে ফরাসী কবি লুই আরাগঁরের "কাব্যের ইতিহাস টেকনিকের ইতিহাস "তিনি পরম যত্নে বুঝিয়েছিলেন । প্রভূত ভাবে আমি বিষ্ণু দের কাছে ঋণী ।তবে কবি বলে আমি তাদের কাছে মিশতে যাই নি । বিষ্ণু দে এমন একজন মানুষ; যিনি রবীন্দ্রনাথ-কে দেখেছিলেন ।যাকে হয়ত রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন আমি প্রকৃতিকে ভালোবেসে দাঁড়িয়ে গিয়েছি । বাংলা সাহিত্যের মাপটা তখন বড়ো ছিল ।সেটা আবৃত্তিকারদের হস্তগত আমলকি ছিল না ।
নিও-ফিজিক্সের একটা ধারণা --- গৃহকোণটি পৃথিবী
নয়।পৃথিবীর কোনো এক প্রত্যন্ত প্রদেশে গৃহকোণ । আপনার সময় গৃহকোণ ও পৃথিবীর মধ্যে কেমন অবস্থান ছিল ?
আমাদের গৃহকোণ আর পৃথিবীর মধ্যে খুব বেশি ফারাক ছিল না । আমি নিজে দেখেছি একজন ছেলে নর্দমার জল খাচ্ছে ।এমনও হতে পারত হাজরা মোড়ে ভাতের থালা হাতে গাড়ির ইঞ্জিনের ধোঁয়ার সামনে একদল মানুষের হাহাকার ।আক্ষরিক অর্থে এমন না হলেও সামগ্রিক পরিবেশ এবং গৃহকোণ ছিল অনেকটা সেরকমই।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র থাকাকালীন সেই সময়ের পরিবেশ সম্পর্কে কিছু বলুন।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি ইলেক্ট্রিকাল এঞ্জিনিয়ারিং-এর ছাত্র ছিলাম ।সেই সময়
মার্কস, লেনিন ,মাও-র দর্শনের পড়েছি কিছু ।মার্ক্সবাদ আমাদের শিখিয়েছে অন্যরকমভাবে পৃথিবীকে দেখতে।প্রশ্ন করতে ।
সিনেমা প্রসঙ্গে বলি আপনি ঋত্বিক ঘটকের ধারক ও বাহক।ঋত্বিক ঘটকের সঙ্গে সাক্ষাৎ মুহূর্ত এবং তার প্রভাবে পরবর্তী জীবনকে বিশ্লেষণ করেছেন কোন ভঙ্গিমায় কোন আলোকে?
এ কথা অনেক জায়গায় বলেছি । আসলে সারা দেশ তখন স্বপ্ন দেখত ।স্বপ্ন দেখতে জানত ।ঋত্বিক ঘটক সেই সব উদ্ধত স্বপ্নের কোনো একটি । আমরা প্রথম বর্ষের ছাত্র তখন । যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের গান্ধী ভবনে এসেছিলেন তিনি ।তার ছবির প্রদর্শন উপলক্ষ্যে ।আর তখনই সুচিত্রা-উত্তমের ভ্রুবিলাস থেকে ঋত্বিক আমাকে টেনে নিলেন ।মেঘে ঢাকা তারা, কোমলগান্ধার ,সুবর্ণরেখা --- আমার চেতনায় আলো পড়ল... সুবর্ণরেখায় অভিরাম যেখানে মাতৃ আবিষ্কার করে স্টেশনের প্লাটফর্মে কৌশল্যাকে।সেই কৌশল্যা কিন্তু বিখ্যাত রাজনন্দিনী নন । একজন বাগ্দী বউ । আমাদের শিল্প সাহিত্যে এটা সতীনাথ ভাদুড়ী ঋত্বিকের আগেই করেছিলেন ঢোরাই চরিত মানসে ।এই যে ইতিহাসকে অন্যরকম ভাবে দেখা যেটা অযান্ত্রিকে তিনি দেখিয়েছিলেন ওঁরাও নাচের মধ্যে দিয়ে ।এত অজস্র কিংবদন্তি লোককথা লোকগানের মধ্যে দিয়ে ঋত্বিক ভারতীয় ইতিহাসের নানা স্তরগুলো -কে পরীক্ষা করেছেন ।যুক্তি তক্ক গপ্প তে ছৌ নাচের মুখোশ বানান যে শিল্পী তার সঙ্গে যখন সংস্কৃত পন্ডিতের সংলাপ হয় ,সেটা ভারতীয় সংস্কৃতির একটা মূল তর্কের দিকে আমাদের নিয়ে যায় ।ঋত্বিককে আমি অনেক কাছের ভাবি এই কারণে যে ঋত্বিক বক্তব্য পেশ করার সমস্ত
প্রথাগুলোকে আক্রমণ করেন।প্রায় নাশকতার দেবদূতের মতই তিনি প্রতিরুপায়ণ এবং সিনেমার আস্থাশীল ধারাবাহিক যুক্তি পরম্পরাকে প্রশ্ন করেন। যার ফলে তার ছবি হয়ে ওঠে একটা বিস্তৃত প্রলয় । সংস্কৃতি বিষয়ে একটা মন্তব্য ।ঋত্বিকের কাহিনীগুলোর গৌরব এমন কিছু নয় । বস্তুত তার সম্পর্কে অনেকেই ভুল ধারণা পোষণ করেন ।তারা বলেন তিনি বাস্তুহারা সমস্যা বা দেশভাগ সমস্যার আখ্যান রচয়িতা । সেটা শুধুমাত্র একটা স্থানিক উপপাদ্য । সেটা একটা সময় যা আমরা গ্রহণ করেছি । ছবি নির্মানের ক্ষেত্রে তিনি আমাদের ধ্যান ধারণা ভেঙ্গে দেন । আজ এতদিন পরে সুবর্ণ রেখা,কোমলগান্ধার,মেঘে ঢাকা তারা, অযান্ত্রিক দেখে মনে হয় ছবিগুলো দেশ ভাগের সময়কে নির্ধারণ করার জন্য নয় । দেশভাগ ছিল একটা উপলক্ষ্য মাত্র।বাস্তবতা তৈরীর জন্য তিনি আধুনিক শিল্পে যে কাজ করেছেন সেটা স্বতন্ত্র।এটা প্রথম শুরু হয়েছিল পিকাসোর চিত্রকলায়।শুরু হয়েছিল নাটকে ব্যের্টল্ট ব্রেখট ,কবিতায় টি. এস.এলিয়ট, উপন্যাসে জেমস জয়েস, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং কবিতায় জীবনানন্দ দাশ থেকে । ঋত্বিকের সময় একমাত্র ফরাসী পরিচালক জাঁ লুক গোদার এই ধরণের প্রস্তাব পেশ করতে সাহসী হন সিনেমায়।গোদার এই প্রবন্ধধর্মিতার সূত্রপাত ঘটিয়েছিলেন সিনেমায় ।এই অ্যান্টিন্যারেটিভ সিনেমার প্রচেষ্টা ঋত্বিক ঘটকের কোমল গান্ধারেও দেখা যায় । জর্জ বিশ্বাস রসিকতার সুরে বলতেন কোমল গন্ডার । আমাদের দুর্ভাগ্য ঋত্বিক ঘটকের কিছু নৈরাজ্য অসাম্যকে আমাদের কলা সমালোচক ,চিত্র সমালোচকরা সঠিক ভাবে বুঝতে পারেনি বা বুঝতা চান নি।ফলে তাদের মনে হয়েছে বাস্তব রচনার সাধারণ পদ্ধতি বিঘ্নিত হচ্ছে । তাই তাদের মনে হয়েছে ঋত্বিক প্রতিভাবান কিন্তু উন্মাদ । আর আমরা তাকে আত্মার আত্মীয় মনে করছি এই কারণে যে তার ছবি দেখলে রাঁবোর মতই মনে হয় এক পবিত্র নৈরাজ্যের উদ্বোধন করেছেন তিনি । সেটা কাহিনীকে চিরদিনের জন্য এক বিশেষ স্তরে নিয়ে যায় । ইতিহাসের সঙ্গে সমকালের যোগসূত্র তৈরী করে । সেটা গল্পের বাইরে একটা দার্শনিকতাকেই তুলে ধরে ।
ঋত্বিক ঘটকের সঙ্গে আপনার ব্যক্তিগত কথোপকথন বা সংলাপের কিছু অংশ যদি তুলে ধরেন তা হলে পাঠক উপকৃত হবেন । তত্কালীন সমাজ-বাস্তব নিয়ে ঋত্বিক কি ধরণের মনোভাব পোষণ করতেন ?
আমার কাছে বিশেষ কিছু উনি বলতেন না ।আমি শুনেছি অপরের সঙ্গে ওর কথোপকথন । ওর ছবি সম্পর্কে মতামত দিলে বড় খুশি হতেন । প্রতক্ষ্য সংলাপের মুখোমুখি হয়েছি ১৯৭৪ সালে । তখনও নন্দন হয় নি । রবীন্দ্রসদনের সামনে দাঁড়িয়ে আছি একজন বন্ধুর জন্য।যাব সিনে ইনস্টিটিউটের -এর বিজনদার কাছে ।জাপানি চলচ্চিত্র উৎসবে কার্ড নিতে। হঠাৎ দেখি দীর্ঘশরীরী ঋত্বিক,আর কী আশ্চর্য !সঙ্গীহীন,সুস্থ,গন্ধহীন । আমার হাত কাঁপছিল। তবু পা ছুঁয়ে ফেললাম । তিনি তাকালেন ,সে চোখে অপার স্নিগ্ধতা । মাঝে মাঝে আবার অন্যমনস্ক । আমাকে বললেন সন্ধ্যে বেলা বোধহয় এদিকে ট্যক্সি পাওয়া যাবে না । চল একটু এগিয়ে দেখা যাক । ক্যালকাটা ক্লাবের সামনে পেয়েও গেলেন । ট্যাক্সির দরজায় হাত রেখে জিজ্ঞাসা করলেন ,তুমি যাবে কোথায় ? বললাম মিউজিয়ামের কাছে ।জাপানিজ ফিল্ম ফেস্টিভালের কার্ড আনতে ।তিনি থমকে গেলেন ।জাপানিজ ফিল্ম কী দেখাচ্ছে ? বললাম কুরুসওয়া আছে । মিজোগুচি নেই ?জিজ্ঞাসা করলেন ঋত্বিক । আমি মিজোগুচির কথা তখনও ভালো ভাবে জানিনা ।মিজোগুচি দেখো --এ তোমার ইম্পোর্ট কোয়ালিটি-র জাপান নয় ।তার ট্যাক্সি ছেড়ে দিল । মৃত ঋত্বিকের পা ছুঁয়ে ছিলাম আমি। শব দেহের জন্য লরির প্রয়োজন ছিল ।লরি পাওয়া যাচ্ছিল না । তত্কালীন এক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের কাছে আমি গেলাম ।তিনি বললেন -- আপনার লরির কী
প্রয়োজন? আমি বললাম আমার নয় ।প্রয়োজন ঋত্বিক ঘটকের ।
লেখায় বক্তব্যে আপনি একটা সুন্দর উপমা ব্যবহার করেন--- প্রত্যাখানের মাতৃভাষা ।এই প্রত্যাখানের ভাষা মানে এক অর্থে না বলার স্পর্ধা । এই না বলা সেই সময়ে সত্যজিৎ রায়-এর ছবিতেও পরিলক্ষিত ।যদি আমি বলি কাঞ্চনজঙ্ঘার উচ্চবিত্ত দাম্ভিক মানুষটির সামনে এক বেকার যুবক মুহুর্তেই ছুড়ে দেন প্রত্যাখানের ভাষা ।তার অট্টহাস্য যেন তীব্র ব্যাঙ্গাত্মক চাবুক ।সেটাও কী হয়ে ওঠে না প্রত্যাখানের মাতৃভাষা ?
আপনার প্রশ্নের গুরুত্ব রয়েছে । ১৯৬১ সালে কাঞ্চনজঙ্ঘায় সত্যজিৎ রায় অস্তায়মান সামন্ততন্ত্রের একটা কথা বলতে চেয়েছেন । আর সত্যজিৎ নিজে একজন সদ্য স্বাধীন দেশের মানুষ ।তার নতুন চিন্তা-চেতনা একধরনের নতুন স্বপ্নকে তিনি পরীক্ষা করতে চেয়েছিলেন ।ছবি বিশ্বাসের চরিত্র-কে আমরা দেখি সম্ভ্রম ও ভয়ের চোখে ।শেষ অবধি ছবি বিশ্বাস হয়ে ওঠেন উপহাসের পাত্র ।ছবির শেষে তাকে দেখা যায় সবাই তাকে ছাড়াই বেঁচে থাকতে পারে। এমনকি তার স্ত্রীও তার ছায়াকে বাদ দিয়ে নিজস্ব অস্তিত্ব অনুভব করে । এটাকে বলা যায় একটা বদলানোর ভাষা ।ছবিটার গঠন অসামান্য এবং সুচারু । এর সঙ্গে জঁ রেনোয়ার সাদৃশ্য আছে ।হয়তো সত্যজিৎ রেঁনোয়ার কাছে থেকে এই পরিকল্পনা পেয়েছিলেন । এই অল্প সময়ে রিল টাইম ও রিয়েল টাইম দেখানো বাস্তবের একটা নতুন মাত্রা আবিষ্কার । কিন্তু দেখা যাবে ছবির সাবভার্সন বা ছবির ভাষাকে আমূল পাল্টে দেওয়ার মতো এক্সপিরিমেন্ট করে না । ঋত্বিক ঘটক কোমল গান্ধারে যে চলচ্চিত্র ভাষা নিয়ে কাজ করেছেন সেটা অপরিচিত এবং তুলনাতীত ।আমরা এই ধরণের সাংস্কৃতিক আঘাত আশাই করি নি ।সত্যজিৎ অনেক বিষয় প্রতাখ্যান করেন যুগের নিয়মে ।যেমন বিদ্যাসাগর বৈধব্য অস্বীকার করেন । সেটার সঙ্গে ইতিহাসের সাধারণ নিয়মের মিল রয়েছে ।অন্যরকম আমূল পরিকল্পনার কথা মনে এলেই ঋত্বিক ঘটকের কথা মনে পড়ে ।ঋত্বিক ঘটকের অযান্ত্রিকে ওঁরাও নাচের যে সংযোজন, সত্যজিৎ রায়ের নন্দন তত্ত্বে এই ধরণের সংযোজন অনুমোদন করে না ।তার একধরনের সম্মত বাস্তব অর্থাৎ অনুমোদিত বাস্তব । ঋত্বিকের ক্ষেত্রে এই অনুমোদিত বাস্তবের কোনো জায়গা নেই। তিনি বাস্তব-কে এক বিশেষ উদ্দেশ্য থেকে নির্মাণ করেন । আধুনিকতাবাদীরা বিভিন্ন স্তরে ও স্বরে বাস্তবকে ভাঙচুর করেন ।সেই রকম বাস্তব ঋত্বিক তৈরী করেছেন। যেমন সুবর্ণরেখা । অনেকগুলো কোইন্সিডেন্সের ওপর কাহিনী দাঁড়িয়ে আছে। খুব নড়বরে একটা কাহিনী । সুবর্ণরেখার "হে রাম "শব্দটা নিয়ে এত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হল তবুও শেষে আমরা বুঝতে পারলাম না এটা কার স্বর । সত্যজিতের সদগতি এই অন্ত্যজ ইতিহাসকে দেখায়। কিন্তু এই দেখানোর পেছনে রয়েছে একটা মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি । অর্থাৎ এই অন্ত্যজ শ্রেণী আমাদের সঙ্গে ছিল কিন্তু আমরা এদের দেখিনি । এটা একধরনের বাস্তববাদী চিত্রভাষা । তার অনবদ্য প্রয়োগ পরিলক্ষিত । ঘটনাক্রমে সদগতির শব্দ প্রয়োগও অসামান্য । যদিও সদগতি ফান্ডামেন্টালী কোনো কিছুকে প্রশ্ন করে না । মুন্সী প্রেমচাঁদ মোটামুটি এই গল্পটা বলছিলেন ।সেটাকে দৃশ্যভাষার স্তর থেকে স্তরান্তরে সত্যজিৎ প্রসারিত করেন ।কিন্তু ঋত্বিক ঘটক সুবর্ণরেখায় অভিরাম ও সীতার প্রণয় মুহুর্তে রামচন্দ্র এবং সীতাকে নতুন করে গঠন করেন তখন বোঝা যায় তিনি মহাভারতকে অন্যরকম ভাবে দেখতে চাইছেন । সতীনাথ ভাদুড়ীর ঢোড়াই চরিত মানস যেমন রাম চরিত মানসকে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেছিল ।তেমনই ঋত্বিক ঘটক ইতিহাসের প্রাথমিক রূপরেখাকে প্রশ্ন করেছেন ।"একশ বছরের নিঃসঙ্গতায় "গার্সিয়া মার্কেজ জানতেন লাতিন আমেরিকার সত্যিকারের ইতিহাস সম্ভব নয় ।কারণ তার অনেক বিস্মরণ-বিস্মৃতি আছে যে গুলো উদ্ধার করা যাবে না । তিনি চান অস্বাভাবিকতার মধ্যে কিছু নুড়ি-পাথর খুঁজে নিতে যাতে লাতিন আমেরিকার প্রাচীন ইতিহাস আধুনিকতার সঙ্গে যুক্ত হতে পারে ।মার্কেজ মূলত যতটা ইতিহাসকার ততটা ঔপন্যাসিক নন। ঋত্বিক ঘটকও যতটা দার্শনিক এবং ইতিহাসকার ততটা ফিলমমেকার নন ।তার ফিলমে মাঝে মাঝে সেই অর্থে ধ্রুপদী আখ্যানের ত্রুটি-বিচ্যুতি চোখে পড়ে । আবার এই ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো স্বাভাবিক । এই ত্রুটি বিচ্যুতিগুলো না হলে বলতে পারতাম না --- " These are the cracks through which poetry or modernity enters."
অযান্ত্রিকের একটি দৃশ্যের কথা উল্লেখ করব,এক নব দম্পতি জগদ্দল নামক গাড়িতে ভ্রমণরত অবস্থায় লক্ষ্য করে গাড়ির ছাউনি ছেঁড়া । সেখানে থেকে দেখা যাচ্ছে মুক্ত উজ্জ্বল আকাশ । এই দৃশ্যটিকে আপনি কি ভাবে ব্যাখ্যা এবং বর্ণনা করবেন ?
এটা অযান্ত্রিকের জটিল মুহূর্ত ।বিদেশীরা হলে বলতেন অটো-এরোটিসম্ । আমি তা বলব না । গাড়ি সম্পর্কে বিমলের বোধ অনেক সময় জড়বস্তুকে অবলম্বন করে যৌনতার বিকাশের নামান্তর ।গাড়ির সঙ্গে তার যে লাজুক মুখচ্ছবি তা তারই প্রমাণ দেয় । আর গাড়িতে অবস্থিত মেয়েটি ছেঁড়া ছাউনির থেকে আকাশের মধ্যে লিরিসিজম খুঁজে পাচ্ছে ।আর তখনই জগদ্দলের প্রতি বিমলের মনোভাবের মধ্যে দিয়ে জগদ্দল ও মেয়েটি পরস্পর পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে । অযান্ত্রিকের কহিনীকে একইসঙ্গে চিত্তাকর্ষক এবং জটিল করে ।
আপনি আপনার লেখায় এক জায়গায় বলেছেন -নিরাপত্তা পুরস্কারমোদী মধ্যবিত্ত সংস্কৃতির ঘেরাটোপ তিনি প্রত্যাখান করেছেন । প্রতিষ্ঠান প্রত্যাখান হানতে দ্বিধা করে নি ।আপনি যৌবনে ঋত্বিককে দেখেছিলেন ।আজ দেখছেন অন্যভাবে। আপনি নিজেই আজ বিশ্ববিদ্যালয় নামক প্রতিষ্ঠানের অধ্যাপক ।এই পরিকাঠামোর মধ্যে থেকে ঋত্বিককে দেখা বা আবিষ্কারের মধ্যে কোনো পার্থক্য রয়েছে ?
এটা যদি নৈর্ব্যক্তিক ভাবে বা এড়িয়ে যাওয়ার জন্য উত্তর দিতাম তাহলে বলা যেতে পারত,এটা একটা দুর্ভাগ্য যে আমাকে একধরনের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো মেনে নিতে হয় । সেটা আমার ডাল ভাত বাড়ি শাড়ি নারী ইত্যাদির জন্য করতে হয় । এই উত্তরটা আমি দিতে চাই না । এটা বোকা বোকা শোনায়। ঋত্বিক ঘটকের মত বড় মাপের শিল্পী যুগের প্রতিস্বর তৈরী করতে চান বলে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কৃতির সাথে তার সংঘাত হবে । ঋত্বিক
প্রতিষ্ঠানের মূল মানগুলোকে প্রশ্ন করবেন বিদ্রুপ করবেন আর প্রতিষ্ঠান বলবে ঋত্বিক তুমি পুরস্কার নাও --- এরকম হয় না ।কোনোকালেই এরকম হয় নি।বোদলেয়ারের সময় বোদলেয়ারকে নিঃসন্দেহে ফরাসী বুর্জোয়ারা মাথায় তুলে নাচেন নি । বুনুয়েল নাজারিন তৈরী করার সময় বলেছিলেন - christ was crucified after being condemned, dont you think that was a defeat ?এই খ্রিস্টের পরাজয় প্রায় সমস্থ শিল্পী এবং সত্যবাদী ব্যক্তির । ঋত্বিকের সেই নিয়তি ছিল ।ঋত্বিক ঘটক চলচ্চিত্র মাধ্যমে বহুবিধ নতুন বিস্ময়ের সঞ্চার ঘটিয়েছিলেন।তত্কালীন সিনেমার টাকাওয়ালা মানুষজন এগুলো সহ্য করতে পারেনি ।জীবনানন্দ ,বোদলেয়ার যেমন সাহিত্যের আজ প্রধান কবি হয়ে উঠেছেন তেমন ভাবে ঋত্বিকও আজ গুরুত্ব পাচ্ছেন । আপনার প্রশ্নের সরাসরি উত্তর হল --- বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামোর মধ্যে ঋত্বিককে পরীক্ষা করেও আগুন থেকে ছুটে আসা ফুলকি ছাএদের মধ্যে যাতে ছড়িয়ে দেওয়া যায় ---সেই চেষ্টা করি ।যারা জীবনের অনির্বচনীয় হুন্ডির সন্ধান পাচ্ছে,যে হুন্ডিগুলো জ্ঞান, নারী,অভিজ্ঞতাকে নির্দিষ্ট পথে পরিচালিত করে, সেই প্রজন্মকে এদের কথা বললে হয়তো আর একটু নতুন সকাল,আর এক ধরণের ভোরবেলা খুঁজে পাওয়া যেতে পারে । মহাকাব্য অনুসারে জীবন এভাবে শুরু হতে চেয়েছিল।আজ দেখছি জীবন খুচরো রিপোর্ট-ও নয় ।এটা একটা অসমাপ্ত প্রয়াস বটে ।এটা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে থেকেও একটা আপেক্ষিক স্বাধীনতা তৈরী করা যায় বলে আমার ধারণা ।
তরুণ বয়সে শুদ্ধ আবেগে ঋত্বিক দেখা এবং পরিণত প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয় ঋত্বিক সম্পর্কিত যাবতীয় আবেগ অনুভূতির তেমন তারতম্য হচ্ছে না বলছেন ?
(হেসে)এই প্রশ্নের উত্তর আমি দেব না ।আসল কথা হল --- একটি বিপ্লবী তার সোনা রুপা ভালবেসেছিল /একটি বণিক আত্মহত্যা করেছিল পরবর্তী জীবনের লোভে /একটি প্রেমিক তার নারীকে-কে ভালবেসেছিল /তবুও মহিলা প্রীত হয়েছিল দশজন মূর্খের বিক্ষোভে ... আমি যেটা বলতে চেয়েছি আপনার প্রশ্নে সেটা হল একটা সাংস্কৃতিক বিকল্প। প্রতি সাংস্কৃতিক বিকল্পের জায়গা থেকে পৃথিবীকে চিনলে হয়ত ভালো হত ।ফুলের স্তবক গৃহ ব্যাতীত অন্যখানেও রাখা যেতে পারে ।আজ যারা সাংস্কৃতিক আধিপত্য করেন তারা বলেন আমারটাই মূল স্বর অন্য কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই।যদিও বা থেকে থাকে সেগুলো অপর বা প্রান্তিক । আসলে এগুলো মূল স্বর হোতে পারে ।
আপনার প্রবন্ধে এক জায়গায় আপনি বলছেন ---যাদবপুর ছাত্রদের কাছে ঋত্বিকের পরিচয় দিতে গেলে অপরাধে মাথা নীচু হয়ে আসে ।এমন মন্তব্যের কারণ কি ?
তার কারণ আজ আমরা সুযোগ সুবিধা প্রচুর পাই ।ঋত্বিক ঘটক খুব কষ্টের মধ্যে দিয়ে ছবি করেছেন এবং মনে হয় প্রায় শূন্য অবিনশ্বর পৃথিবীকে নিবেদন করেছেন ।ঋত্বিক ঘটকের কোনো মূল্যায়নই তেমন হয়নি ।এখন মাঝে মধ্যে অপরাধ বোধে মাথা নীচু হয়ে আসে । কারণ আমরা আধুনিক সিনেমা সম্পর্কে অনেক কথা বলি ।কিছুদিন আগে এই কথা বললে-- অনন্ত বিচিত্র মৃত্যুর আগে শান্তির বা বিশ্রামের কিছু প্রয়োজন আছে --- এই ভেবে ঋত্বিক ঘটক চোখ বুজতে পারতেন । এই জন্যই আমার অপরাধে মাথা নীচু হয়ে আসে।
আপনি মার্কস,মাও শিক্ষায় দীক্ষিত ।আজকের সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিতে সাম্যবাদ কতখানি প্রাসঙ্গিক ?
মার্কস আমাদের কাছে সাম্প্রতিকতম সবচেয়ে বড় দার্শনিক।এটা একটা হাতিয়ার যাকে অবলম্বন করে মানুষ স্বাধীনতার চর্চা করতে পারে।মার্কসের অবদান এখানেই । রাষ্ট্রব্যবস্থা কি সেটা রাজনীতির প্রশ্ন ,সমাজনীতির প্রশ্ন ।মার্কসের অবদান শুধু রাষ্ট্রনৈতিক চিন্তার ক্ষেত্র নয়।মার্কসবাদ আমাদের প্রশ্ন করতে শিখিয়েছে । সামাজিক সমীকরণের ক্ষেত্রে মার্কসবাদ এখনো কাজ করে বলে আমাদের বিশ্বাস ।
আপনি নকশাল আন্দোলন দেখেছেন । নকশাল আন্দোলনকে আপনি কি চোখে দেখেন ?
প্রত্যেক যুগের ধর্ম থাকে ।যেমন অগ্নিযুগের বিপ্লবী । এই কথাটা বললে আজকের ছাত্রদের কাছে কোনো মানে হয় না ।কিন্তু বিনয় বাদল দীনেশ বা কানাই লাল দত্ত ভগৎ সিং এই মানুষগুলো বিদেশী শাসন ব্যবস্থার ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিলেন ।এদের আত্মত্যাগের মাধ্যমে আমাদের কিছু উদ্দীপনা তৈরী করেছিল। আপনি যে সময়টার কথা বলছেন তখন বিশাল এক যুবসম্প্রদায় কথা বলেছিলেন।তাদের কথার মধ্যে কিছু ভুল আছে ।কিন্তু একটা বিষয় ঠিক স্বাধীনতার ফাঁকিটা যে ভাবে ধরা পড়েছিল যে ভাবে ৬৭ থেকে ৭২ সাল অবধি গ্রাম বাংলা এবং শহরে মূলত যুবকরা যে প্রশ্নগুলো তুলেছিল সেগুলো স্থিতাবস্থার মধ্যে অস্থিতি এনেছিল । একটা জমা জলকে সমুদ্রের দিকে ঠেলে দিয়েছিল ।তার পরিণতি হিসেবে অনেকগুলো নতুন প্রশ্ন উঠে আসছিল সমাজে।মানুষ বদল চায় ।মানুষের মধ্যে যে মনীষার আলো রয়েছে সে আলো সে যাচাই করে নিতে চায় ।সেই যাচাই কখনো ভগৎ সিং ,কখনো রাস্তায় শুয়ে থাকা শহীদের মাধ্যমে উঠে আসে ।
এই যে মন্তব্য রবীন্দ্রনাথ বুর্জোয়াদের কবি এসব কি সমর্থন যোগ্য?
এগুলোকে সমর্থন করার কোনো প্রশ্নই নেই ।এগুলো ভুল ।ব্রিটিশরা যাদের সন্ত্রাসবাদী বলত আমরা বলতাম স্বাধীনতা সংগ্রামী ।তাদের আত্মত্যাগ তুলনাতীত । বীরত্ব আকাশ প্রমাণ। সততা প্রশ্নাতীত ।এই যে রবীন্দ্রনাথকে বুর্জোয়া বলা --- এর মধ্যে উত্তেজনা,
আবেগ আছে আবার আমরাই ঠিক এই দম্ভও যতটা আছে ততটা সত্য নেই ।ক্ষুদিরাম ভুল করে কিংসফোর্ডের গাড়িতে বোমা না মারলে ব্রিটিশরা বুঝতেন না কোথাও অশান্তি ঘনীভূত হয়ে উঠেছে ।কাজটা ভালো ছিল না ।ভুল ছিল । সন্ত্রাসবাদকে আমি সমর্থন করি না । জোড় করে কারো মতামত কেড়ে নেওয়া যায় না । কিন্তু এই ছেলে-মেয়ে গুলোর ব্যক্তিগত আত্মত্যাগের কথা ভাবলে দেখা যাবে যে এখনো নিজেদের কিছু ভাবার আছে বাকি ।রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন --- বাহিরিয়া এলো কারা /মা কাঁদিছে পিছে /প্রেয়সী দাঁড়ায়ে নয়ন মুদিছে /ঝড়ের গর্জন মাঝে বিচ্ছেদের হাহাকার বাজে /ঘরে ঘরে শূন্য হল আরামের শয্যাতলে/ যাত্রা কর যাত্রা কর যাত্রাদল উঠেছে আদেশ /বন্দরের কাল হল শেষ । এটা বলার জন্য ইতিহাস কাউকে দায়িত্ব দেয়। সেই ছাত্রদের মধ্যে দায়িত্ব দেওয়াটা সঠিক কি বেঠিক সেটা ইতিহাস-ই বুঝতে পারে ।
আপনার সময় বাংলা থিয়েটার-এর স্বর্ণ যুগ ছিল । শম্ভু মিত্র ,উত্পল দত্ত ,বিজন ভট্টাচার্যের সৃজন কর্ম কি কোনো ভাবে আপনাকে প্রভাবিত করেছিল ?
থিয়েটারের প্রতি আকর্ষণ আমার কম ছিল । সে সময় উত্পল দত্তের নামে জনতার সমাগম হত ।অজিতেশ-কে আমি যাদবপুরের অঙ্গনেও দেখেছি । শম্ভু মিত্র আমাদের যৌবনে তেমন ছিলেন না । তার আগেই অবসর নিয়েছিলেন ।গ্রামে-গঞ্জে মফস্বলে থিয়েটার সে সময়ে একটা সজীব ঐতিহ্য ছিল । থিয়েটার ক্রমাগত মানুষকে বদলায়। দেহ বিভঙ্গে ,স্বরক্ষেপণে বদলের ডাক দেয় । থিয়েটার বাঙালির মাতৃভাষা ছিল। দুঃখের কথা বাঙালি থিয়েটার থেকে কিছুটা হলেও হাত গুটিয়েছে। বাঙালি সব সময় নাটক ভালো লেখেনি । কৃষ্ণ
কুমারী,রক্তকরবী ,মুক্তধারা,নবান্ন ব্যতীত বাঙালি কম ভালো নাটক লিখেছে ।উত্পল দত্তের টিনের তলোয়ার বাদে নাটক পাঠ্য হিসেবে উত্কৃষ্ট হয়েছে কি !আমি জানি না ।কিন্তু পারফরমেন্সের ক্ষেত্রে দানীবাবু, শিশির ভাদুড়ী থেকে শম্ভু মিত্র,অজিতেশ,রুদ্রপ্রসাদ ,উত্পল দত্ত ---- এরা এত উচ্চমানের ছিলেন যেটা আজ প্রায় স্বপ্নাতীত ।উত্পল দত্ত কে আমি দেখেছি ।একজন মানুষের উপস্থিতি এবং উপস্থিতহীনতা জনমানসে বিপুল প্রভাব ফেলে । দুঃস্বপ্নের নগরীতে ওনার অভিনয় ছিল না।পরিচালনা ছিল । আজকের বাঙালিকে বোঝানো যাবে না উত্পল দত্ত মঞ্চে কত জীবন্ত ছিলেন । বোঝানো যাবে না শম্ভু মিত্রের সজীবতা ।রাজা অয়দিপাউস নাটক আর রিক্রিয়েট করা সম্ভব নয় ।এগুলো দুঃখের ।
আপনি এল .টি .জি -র উত্পল দত্ত এবং পি এল টি-র উত্পল দত্তের মধ্যে কোনো ফারাক লক্ষ্য করেছিলেন ?
আমি উত্পল দত্ত-কে দেখেছি যখন উনি মিনার্ভায় তিতাস একটি নদী নাম করছেন ,অঙ্গার করছেন, আমাদের এক আত্মীয় নিয়ে গিয়েছিলেন। উত্পল দত্তের সাংস্কৃতিক গুরুত্ব তখন বুঝতাম না । উত্পল দত্তের ফেরারী ফৌজ দেখে আমি স্বাধীনতার শিক্ষা নিয়েছি ।বা অঙ্গারে তাপস সেনের আলো যেটা না দেখলে বোঝান যাবে না ।
দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ নাটকের ফলে যে জন আন্দোলন গড়ে উঠেছিল তেমন ভাবে কি নাটক রাজনৈক-সামাজিক হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে ?
নবান্নর কথা আমি বলব ।কৃষক আন্দোলনের অন্যতম হাতিয়ার হয়ে উঠেছে ।এরা মৃত্তিকাচ্যুত ছিলেন না । মাটির কান্নাই এদের অভিনয় করাত।আজ আমাদের পায়ে যতটা মাটি লাগে তার চেয়ে অনেক বেশি আইসক্রিম ঠোটে লাগে।হাবিব তনভির মারা গেছেন । তার নাটক যেমন নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠী বুঝতে পারত ।আজকের নাটক কাদের কথা বলে সেটা বোঝা একটু দুষ্কর । এটা একটা সান্ধ্যভাষা । আমরা সকলেই সকলের মুখ দেখি ।
বর্তমানে রুদ্ধসঙ্গীত নাটকে দিনের পর দিন মানুষের ভিড় উপচে পড়ছে। তার মানে মানুষ পছন্দ করছেন। এত জনপ্রিয়তার কারণ কি ?
এর কারণ হল এটা বাঙালীর লুপ্ত নস্টালজিয়া । কিছুদিন বাদেই বোঝা যাবে এটা ট্রিবিউট টু ভারতীয় গণনাট্য সংঘ ।এটা ডেরিভেটিভ নলেজ । বামপন্থী বামপন্থা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে এবং তাদের জন্য এটা রাজনৈতিক ইস্তেহার। ঘটনাক্রমে সমাজের সঙ্গে মিলছে বলে মানুষ দেখছেন ।নাটকের চরিত্র দেবব্রত বিশ্বাস ,ঋত্বিক ঘটক বা হেমাঙ্গ বিশ্বাসের মাধ্যমে একটা স্মৃতি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চলছে ।
এখনকার গণমাধ্যম সম্পর্কে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি কি ?
টেলিভিশন এবং সংবাদপত্র প্রতিদিন নতুন নতুন প্রতিবেদন তৈরী করে । এবং শিল্পীর সব চেয়ে বড় চ্যালেন্ঞ্জ হল প্রতিদিন কি করে শিল্প গড়বে। না কি সে অনেকদিনের জন্য শিল্প গড়বে ।এখন প্রতিদিনের মত শিল্প গড়া অনেক সময় আইসক্রিমের মত সুলভ এবং সস্তা হয় মাঝে-মাঝে।এখন ব্যবসায়ের খাতিরে কিছু করার নেই । এখন বহুজাতিক সংস্থা কখনো নবান্নর জন্য টাকা দেবে না।প্রতিদিন আপনাকে নতুন জিনিস দিতে হবে ।যেমন রেঁস্তোরায় নতুন খাবার না হলে লোক আসবে না ।এখন চিরনতুনত্ত্ব শিল্পের হাতিয়ার হতে পারে না।নতুনত্ব একমাত্র শিল্পের অভিজ্ঞান নয় । তাহলে রবীন্দ্রনাথ অনেক আগেই পুরানো হয়ে যেতেন ।
রবীন্দ্রনাথ বলতেই আবার কবিতার কথা মনে পড়ল ।বিষ্ণু দে বাদেও তো আপনি বহু কবির সান্নিধ্য পেয়েছিলেন।তাদের কথা কিছু শুনি ।
হ্যাঁ ১৯৬৮ সালের শেষ দিকে ।৫০ দশকের কবিরা তখন খুব নাম করা ।সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের নাম তখন বেশ তুঙ্গে ।শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে তখন প্রায় কিংবদন্তি মনে করা হত ।দেয়ালে দেয়াল /কার্নিশে কার্নিশ /ফুটপাথ বদল হয় মধ্যরাতে ।শক্তির মত্ততা,কন্ঠস্বর তার সহজাত প্রবৃত্তি একধরনের কবিতার চেহারা গড়ে তুলেছিল। শক্তি দার সঙ্গে আমার আলাপ ছিল ।মূলত শক্তি দা আমাদের স্নেহ করতেন ।কবি বলতে কি বোঝায় অনেকদিন অবধি আমার ধারণা ছিল শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে দেখে। শক্তি দার কথা ভাবলে আমার মনে হয় --- আলৌকিকতার কাছে সবার আকৃতি ঝড়ে যায় ।শক্তি অন্তরীক্ষচারি ছিলেন ।প্রাচীন গ্রীকেরা যেমন বলতেন দৈবীয় উন্মাদনা তেমনি শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে দেখে আমাদের মনে হত।এই জন্য শক্তি দার গ্রহণযোগ্যতা ছিল । শক্তি দা -- "এসেছিলে তবু আস নাই জানায়ে গেলে পলাতক ছায়া ফেলে "---এই ভাবে আমাদের কাছে ছিলেন বেঁচে।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কথা আপনি বলেছেন।যৌবনে সুনীল বাবু যে উক্তি করেছেন বিভিন্ন কবি সম্পর্কে পরবর্তী সময় সেগুলোকে অগ্রাহ্য করেছেন ।এগুলোকে আপনি কি বলবেন ?
সুনীল দার সাথে ব্যক্তিগত পরিচয়ে আমি দেখেছি তিনি যতটা ক্যাজুয়াল বলে প্রচার করেন ততটা তিনি নন ।তার মধ্যে একটা সিরিয়াসনেস আছে এবং সেই সিরিয়াসনেস না থাকলে তিনি ভালো লেখা লিখতে পারতেন না ।কবিতায় তার সত্যি অবদান আছে । আর ৬০,৭০ দশকে তিনি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের গুরুত্ব পেতেন না ।কিন্তু দলপতি হিসেবে তার যোগ্যতা প্রমাণিত হয়েছিল। প্রমাণিত হয়েছিল যে তিনি সমস্থ ৫০ দশককে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন । তার "আত্মপ্রকাশ"উপন্যাস প্রকাশিত হবার পর আমাদের বুকটা সত্যি মুচড়ে ওঠে । সুনীল দার ব্যাপারে আমাদের অভিমান ছিল । যিনি লিখেছিলেন -"কথা দিয়েছিলে তুমি উদাসীন সঙ্গম শেখাবে "---তিনি কেন উপন্যাস লিখেছিলেন ।তার ভাষায় খবরের কাগজ যেন জল মেশানো গদ্য । এসব নিয়ে সুনীল দাকে আমরা লিখিত আক্রমণ করেছি।সুনীল
গঙ্গোপাধ্যায়ের এসব খেয়াল করেছেন । এবং আমি মানুষটির সবচয়ে বড় গুণ বলব--- ব্যক্তিগত বিদ্বেষের লোক নন । তিনি এসব মনে রাখেন নি। আমি সুনীল দাকে বলেছিলাম সুনীল দা আমরা ছোটবেলায় আপনাকে অনেক আক্রমণ করেছি । তিনি সেগুলোকে মাছি তাড়ানোর মত উড়িয়ে দিয়ে বললেন --- ছোটবেলার ধর্ম ওগুলো।ওগুলো না করলে লোকের চোখে পড়বে কি করে !
আপনার শৈশব,যৌবন এবং মধ্যবয়সের অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে প্রেমের ধারণা কি বদলেছে ?
বয়স হলে প্রেমের সঙ্গে শরীরে স্নেহ যুক্ত হয় ।কিন্তু রোমান্টিক প্রেম বা ভালবাসার মধ্যে একটা পরাযৌক্তিক মাএা থাকে। সেই পরাযুক্তি নানা স্তরে কাজ করে যায় ।শুধু প্রেম বলতে শারীরিকতা বোঝায় তাহলে ভুল করা হবে ।আবার শারীরিকতা বাদ দিয়েও প্রেম হয় না । প্রেম নিয়ে বিভিন্ন সময় মানুষ বিভিন্ন ভাবে ভাবিত হয়েছে ।আমি অনেক বৃদ্ধকে দেখেছি তার নারীর জন্য তিনি যে আকূলতা প্রকাশ করেছেন সেই আকুলতার মধ্যে যুক্তিহীনতা আছে ।আমার মনে হয় নারী অন্যধরনের আশ্রয় ।অন্যধরনের পাখির নীড়
।অন্যধরনের ব্যঞ্জনা । আমরা যে ভাবে বেঁচে আছি সেই ছন্দটা আমাদের অনেক সময়
ভালো লাগে না ।সেরকমভাবে জীবনের কোনো ঘর ফাঁকা থাকলে সেই ঘরে আকাশ বা বাতাস খোঁজার জন্য কোনো নারীকে খোঁজা যেতে পারে।
এবার একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন । আপনার নিজস্ব
লেখা ,জীবন,জগতকে অন্যভাবে আবিষ্কার করাকে আপনার স্ত্রী ,পুত্র বা আত্মীয়স্বজন কোন দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখেন ?
আমি পূব বাংলার মধ্যবিত্ত স্তর থেকে উঠে আসা মানুষ ।আমরা মানে আমি আমার স্ত্রী চেষ্টা করেছি সেই মধ্যবিত্ত জীবনকে ধরে রাখতে ।তার মধ্যে খুব একটা হয়ত সাহিত্য-শিল্প ঢুকছে,তা নয় ।আমরা বাড়িতে কচু বাটা খেয়ে আনন্দ পাই ।কলাই শাক লংকা বাটার সঙ্গে খেয়ে আনন্দ পাই । শীতকালে আড় মাছ আমাদের ভালো লাগে ।চিতল মাছের মুইঠ্যা বর্তমানে শনিবারের পাতায় না পড়ে বাঙাল ধরণের তৈরী করে খাই।তাতে অনেক সময় হয়ত মনে হয় আমার স্ত্রী আমার লেখা কাজকর্মের সঙ্গে বেশি পরিচিত হলে ভালো হত ।তিনি শিক্ষিতা । আমার লেখা তার কাছে কতটা পরিচিত আমি কখনো সেটা জিজ্ঞাসা করিনি। তিনিও আমার কাছে জানতে চাননি ।কারণ মনে হয় নি আমাদের দৈনন্দিন জীবন-যাপনে এটা খুব প্রয়োজন ।এর জন্য যে কখনো মন খারাপ হয় না, তা নয় । আমার মনে হয় জীবনটা সব সময়ের অনুযোগের নয় ,এ্যাকোমডেশনের।এখন এ্যাকোমডেশন করে নিতে হয় ।আমরা মুসুরের ডালে পাঁচফোরণের গন্ধ পেয়েই খুশি আছি ।আমার ছেলে বড় হয়ে গেছে ।সে ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে গবেষণা করে । সে আমার লেখা আদৌ পড়েছে কিনা জানিনা । তবে তার কোনো কোনো বন্ধু পড়ে। হয়ত বাবার সম্পর্কে তার একটা ধারণা আছে ।তবে পিতা-পুত্রের সংলাপ আমি বিলম্বিত রেখেছি ।একটা সময় নিশ্চয়ই আমাকে আমার ছেলের মুখোমুখি হতে হবে ।তখন আমরা পরস্পরের সঙ্গে সমঝোতা করে নিতে পারব ।আমি খানিকটা উনিশ শতকের রেওয়াজের পক্ষপাতী। বঙ্কিম চন্দ্র কি তার স্ত্রীর সঙ্গে সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করতেন ---- আমার মনে হয় না । এর একটা যুক্তি হতে পারে বঙ্কিম বাবুর স্ত্রী শিক্ষিতা ছিলেন না । আর একটা হতে পারে আমি বঙ্কিম বাবু নই । আমার মনে হয় বেঁচে থাকার নিজস্ব ধর্মতো আছেই । সেটা বয়ে যাক না ! সে জন্য আলাদা পরিবেশ,লেখক লেখক বাড়ি-তার খুব একটা প্রয়োজন আছে বলে আমার মনে হয়
না।আমার মনে হয় বাঙালীরা যবে থেকে বাড়িকে সরস্বতীর মন্দির হিসেবে গড়ে তুলল,তবে থেকেই সরস্বতী তাদের ছেড়ে চলে গেল ।
শেষ প্রশ্ন । শৈশব ,যৌবন,মধ্যবয়সের কোনো ঘটনা কি সরাসরি শিল্পে রূপান্তরিত হয়েছে ?
শৈশবে আমি খুব স্বাধীন ছিলাম না ।বাইরের পৃথিবী খুব উন্মুক্ত ছিল, তা নয় ।আমার মধ্যে একটা বিষন্নতা কাজ করে।শীতকালের সন্ধ্যা আমার কাছে একটা সক্রিয় স্মৃতি ।এটা আমাকে নানারকম ভাবে ভাবায় । যেমন শরত্কালে আমার মা রিঠা দিয়ে চুল পরিষ্কার করত । তারপর একটা আলো এসে পড়ত সেটাই আমার কাছে শরত্কাল । স্মৃতি সংলাপ হিসেবে আমার কাছে ধরা পড়ে । এখানে প্রশ্ন আসতেই পারে তাহলে কেন আমি গল্প উপন্যাস--- লিখলাম না ? গল্প-উপন্যাস লিখি না কারণ আমার প্রবন্ধগুলো পড়লে দেখবেন সেখানে আমি ইচ্ছে করেই বিশ্লেষণাত্মক মন্তব্য কম রাখি । আমি আমার অনুভূতিগুলো ব্যক্ত করতে চাই ।সেগুলো প্রবন্ধ নিরপেক্ষ ভাবে আমার মতামত থাকে । আমি হিন্দুদের মত সাকার প্রতিমা পূজা করি । একটা কাঠামো থাকে ।আমি চেষ্টা করিএকটা কাঠামোকে অবলম্বন করে একটা মূর্তি গড়া যায় কি না ।এটা একটা ফর্ম ।
আলাপচারিতায় : তন্ময় দত্ত গুপ্ত